দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার লুঙ্গি এনগিডির বাউন্সারটি সৌম্য সরকারের ব্যাট থেকে ফরোয়ার্ড স্কয়ার লেগ বাউন্ডারি স্পর্শ করল বিদ্যুৎগতিতে। ফ্রন্ট ফুট থেকে পুল করলেন সজোরে। ঠিক বলে চোখ রেখে। দারুণ মাথার অবস্থান, চোখ আর হাতের সমন্বয়ে কোনো খুঁত নেই। পরের বলে একই শট, একই ফলাফল। স্লিপে দাঁড়ানো ফাফ ডু প্লেসি নখ কামড়াচ্ছেন। ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ, যিনি নিজেও একজন ফাস্ট বোলার ছিলেন, চড়া আওয়াজ তুলে সৌম্যর প্রশংসা করলেন। ফাস্ট বোলিংয়ের জবাবটা এভাবেই দেন এখনকার বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা।
এ প্রজন্মের মতো এমন ভয়ডরহীন ব্যাটিং করার কথা চিন্তাও করেনি ২০ বছর আগের বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা। ফাস্ট বোলিং সামাল দেওয়ার জন্য যা দরকার, তার কিছুই ছিল না বাংলাদেশ ক্রিকেটে। অনুশীলনের সরঞ্জাম, উন্নত মানের গিয়ার…দুটোর কোনোটিই না। ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের পরিসংখ্যানেও একই প্রতিফলন স্পষ্ট প্রতীয়মান।
২০০০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে মাত্র ১৭.৭৩ গড়ে রান তুলেছেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা। গতি দিয়ে বাংলাদেশকে গুঁড়িয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়মিত চিত্র ছিল। পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে দুর্বল বাংলাদেশ দল তখন কালেভদ্রে জয়ের দেখা পেত।
পেসের বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটিং গড়
সাল
গড়
২০০০-০৪
১৭.৭৩
২০০৫-০৯
২৬.০৩
২০১০-১৪
২৮.১৭
২০১৫-১৯
৩৩.১৪
সেই আশির দশক থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাক্ষী জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন। যুগের সঙ্গে যুগের পার্থক্য জানিয়েছেন প্রথম আলোকে, ‘আগে আর এখন তো অনেক তফাত। আগে তেমন কোনো অবকাঠামো ছিল না। সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার সময়ের তুলনা চলে না। এখন তো অনুশীলনের সুবিধায় অনেক উন্নতি এসেছে। ফাস্ট বোলিং খেলার জন্য যে অনুশীলন করা দরকার, এখন সেটা করা হয়। এত গার্ড, আর্ম গার্ড, হেলমেট আগে ছিল না। এখন তো পুরো প্রস্তুত হয়ে ফাস্ট বোলিং খেলতে নামে ছেলেরা। এখন ভয়ের কিছু নেই। এখন তো ওদের সাহস অনেক বেশি। আগে একটা ফাস্ট বোলারকে খেলব, আমাদের প্রস্তুতি নিতে হতো কল্পনা করে, মানসিকভাবে। এখন আপনি ১৪০-১৫০ কিলোমিটার গতি বলে অনুশীলন করছেন নিয়মিত।’
বাঁকবদলের শুরু মূলত ২০০৬-০৭ সাল থেকে। ১৭-১৮ বছর বয়সের সাকিব-তামিমরা ফাস্ট বোলারদের চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়া শুরু করেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা জহির খানকে কী দারুণভাবেই না শাসিয়েছেন তামিম। নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের বিপক্ষে ইতিবাচক ফল আসা শুরু করে আশরাফুল-তামিম-সাকিবদের হাত ধরেই। পরিসংখ্যানও তা–ই বলে। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালে ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের গড় বেড়ে দাঁড়ায় ২৬.০৩ রানে, পরের চার বছরে উন্নত হয় ২৮.১৭ রানে।
দেশের হয়ে ২৪ টেস্ট ও ৭৫ ওয়ানডে খেলা শাহরিয়ার নাফীসের চোখে পার্থক্যটা আকাশ-পাতাল। কোথায় ছিল বাংলাদেশ আর এখন কোথায় এসেছে! নাফিসের কথায়, ‘বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে ২০০০ সালে। এরপর থেকে আমরা নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেতে থাকি। তখনকার সঙ্গে এখনকার পারফরম্যান্সের আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকবে। শুরুর দিকে বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ ছিল না। তারপর দেখা গেল, সময়ের সঙ্গে একটা বোলিং মেশিন আনা হলো, দুইটা বোলিং মেশিন আনা হলো। এভাবে আমরা গতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শুরু করলাম। ঘরোয়া ক্রিকেটে বোলারদের গতি বাড়া শুরু করল। এভাবে করতে করতেই সবকিছুর উন্নতি। অনুশীলনে অনেক উন্নতি হয়েছে। আমাদের বোলাররাও জোরে বল করতে শুরু করেছে। আগে সুযোগ-সুবিধা যেমন কম ছিল। আমাদের পেস বোলারদের গতিও কম ছিল।’
শাহরিয়ারের ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে শোয়েব আখতার, ব্রেট লি, শেন বন্ডের মতো ফাস্ট বোলাররা দাপট দেখিয়ে গেছেন। তবে শাহরিয়ার শোনালেন ভিন্ন কথা, ‘ভয় কাজ করত না। ভালো আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার যারা, তাদের মধ্যে ভয় কাজ করত না। তাদের মধ্যে হয়তো অনিশ্চয়তা কাজ করত। আমি পারব কি পারব না, এমন অনুভূতি কাজ করত।’
নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০০০ সালের শুরুর দিকে কম ম্যাচ খেলত বাংলাদেশ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাচসংখ্যা বেড়েছে। খেলতে খেলতে হাত পেকেছে সাকিব-তামিমদের। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে ৩৩.১৪ গড়ে রান তুলে আসছে। সৌম্য সরকারের মতো এ যুগের বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানরা স্পিনের চেয়ে ফাস্ট বোলিংয়ে বেশি সাবলীল। শাহরিয়ারের ভাষায়, ‘আমরা যখন বাইরের দেশের সঙ্গে খেলা শুরু করেছি, ভালো ভালো ফাস্ট বোলারকে সামলানো শুরু করেছি, তখন থেকেই আমাদের খেলার ধরন বদল হওয়া শুরু করেছি, মানিয়ে নেওয়া শুরু করেছি। এখন আমরা ফাস্ট বোলিংয়ে ভালো খেলছি।’
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পরের ম্যাচটি পাঁচ পেসারদের দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এখন পর্যন্ত চার ম্যাচে ২৪ উইকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ—সব কটিই পেয়েছেন ওদের পেসাররা। তবে এই বাংলাদেশ এখন আর গতি ভয় পায় না, বরং উপভোগ করে।