কক্সবাজার জেলার সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে মাদক ও অস্ত্রবাজদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ, আটক ও মামলা হওয়া সত্ত্বেও থেমে নেই ইয়াবা পাচার। একদিকে ইয়াবা পাচার অন্যদিকে তাদের সঙ্গে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ, আটক ও মামলায় রীতিমতো আতঙ্ক ও উদ্বেগের মাঝে রয়েছে টেকনাফবাসী। তবে সীমান্ত উপজেলার পুলিশ, র্যাব, ও বিজিবি বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর থেকে কঠোরতর অভিযানের কারণে প্রায় ৭০ ভাগ ইয়াবা ব্যবসা কমে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শত জল্পনা কল্পনা অবসান ঘটিয়ে ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। কিন্তু বন্ধ হয়নি ইয়াবার পাচার। টেকনাফ থানা পুলিশের উদ্যোগে ইতোমধ্যে মাদক, জঙ্গি, সন্ত্রাসবিরোধী সভা সেমিনার প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ৮ এপ্রিল হোয়াইক্যংয়ে মাদকবিরোধী সভার মাধ্যমে শেষ করা হবে এ সভা। পাশাপাশি ওয়ার্ড পর্যায়েও কমিটি করার উদ্যোগ নিয়েছে টেকনাফ থানা পুলিশ। এর পরেও আগের মতোই প্রতিনিয়ত আসছে ইয়াবা। তাই এখনো উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাটেনি এলাকাবাসীর।
এলাকাবাসীরা বলছে, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একাংশ আত্মসমর্পণ করলেও এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। অনেক গডফাদার আছে যারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ ইয়াবার তালিকায় এই প্রভাবশালী গ্রুপটিই সবার উপরে। তাদের থামানো না গেলে টেকনাফ ইয়াবা মুক্ত হবে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকা অনুযায়ী, টেকনাফের শীর্ষে রয়েছে সাবেক এক সংসদ সদস্যের নাম। তার পরিবারের ১২ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও তার ছেলে পৌরসভার কাউন্সিলর প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এছাড়াও টেকনাফ উপজেলার ভাইসচেয়ারম্যান মেমৗলভী রফিক উদ্দিন, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিনসহ ওই তালিকায় নাম থাকা বেশিরভাগ প্রভাবশালী রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকাবাসীর দাবি তালিকা নাম থাকলেও যারা গ্রেপ্তার হয়নি তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে ইয়াবা ব্যবসা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ইয়াবা ব্যবসা করে রাতারাতি ধনি হওয়ার আশায় টেকনাফের বেশিরভাগ লোক এ ব্যবসায় নাম লেখায়। বর্তমানে এটি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু কিছু প্রভাবশালী মহল ঠিকই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে টেকনাফের যে দুর্নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়িয়েছে সেটি থেকে আমরা বেড় হতে পারছি না। কোথায় গিয়ে টেকনাফের পরিচয় দিতে মন চায় না। একমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেই এই সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে।
আত্মসমর্পণের বিষয়ে তারা বলেন, যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদেরকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু তারা বের হয়ে আর ইয়াবা ব্যবসা করবে না এর গ্যারান্টি কে দিবে। আর তাদের সিন্ডিকেটগুলোই বা কোথায়? তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে টেকনাফকে ইয়াবামুক্ত ঘোষণা করা হোক।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আবারো দ্বিতীয় ধাপে আত্মসমর্পণ করবে ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, আত্মসমর্পণ ইয়াবা পাচার বন্ধের শেষ বিষয় বা সমাধান নয়। ইয়াবা পাচার বন্ধ করতে হলে সীমান্তে ও জলপথে নিশ্ছিদ্র টহল ও কঠোর নজরদারী বাড়াতে হবে। অন্যথায় কখনো ইয়াবা পাচার বন্ধ হবে না।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন আরটিভি অনলাইনকে বলেন, বড় বড় ইয়াবাকারবারি গা ঢাকা দিলেও যাদের নূন্যতম আইন সম্পর্কে ধারণা নেই তারাই মূলত ইয়াবা পাচার করছে এখনো। প্রতিটি ওয়ার্ডে মাদকবিরোধী কমিটি গঠনের লক্ষ্যে ৫০ থেকে ৫৫ জন সচেতন লোকজন নিয়ে এ কমিটি গঠন করা হবে। সেখানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে জড়িত করা হবে।
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আরটিভি অনলাইনকে বলেন, টেকনাফের কোনও ইয়াবা ব্যবসায়ীকেই ছাড় দেয়া হবে না। আগের তুলনায় টেকনাফে ইয়াবার ৭০ শতাংশ চালান কমে গেছে। পর্যায়ক্রমে আরও কমে আসবে। প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলায় মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট ইয়াবা ব্যাপারীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। তারপরেও তারা আত্মসমর্পণ করছেন না। এটা খুবই দুঃখজনক। পুলিশ নিজ থেকে কাউকে ক্ষতি করেন না। ইয়াবা ও অস্ত্রের সংবাদ পেয়ে উদ্ধার অভিযানে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে (সরকারী জান, মাল রক্ষার্থে) পাল্টা গুলি ছুঁড়ে থাকে।
তবে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণের বিষয়ে ওসির কাছে এখন পর্যন্ত কোনও বার্তা নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে টেকনাফ থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪৯ মামলার বিপরীতে ২২৬ আসামীর মধ্যে ১৭০ জন গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিজিবি জানায়, মার্চ মাসে জব্দ করা হয়েছে ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৩৫৪ পিস ইয়াবা। ২০ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২ জনকে। বন্দুকযুদ্ধে রোহিঙ্গা নারীসহ মারা গেছেন ৬ জন। এছাড়া ধরা পরেছে ফেনসিডিল, গাঁজা, আন্দামান গোল্ডসহ নানা মাদক।
৫ এপ্রিল দুপুরের দিকে ১৯ হাজার ৫শ’ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে বিজিবি। এছাড়া কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, র্যাবের অভিযানেও বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও আটক রয়েছে।
গত বছরের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হয়। এ অভিযানে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ এবং মাদককারবারীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে কক্সবাজার জেলায় ৭২ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে এক নারী ও ১৪ জন রোহিঙ্গাসহ শুধু টেকনাফে ৫৭ জন নিহত হয়েছেন।
সর্বশেষ ৬ এপ্রিল টেকনাফের নয়াপড়া মোচনী শরণার্থী ক্যাম্পে পুলিশ অস্ত্র উদ্ধারে গেলে রোহিঙ্গা সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিন রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পুলিশের তিন সদস্যও। ঘটনাস্থল থেকে ৪টি এলজি ও ৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।