দুষ্কর্মের রেশ থেকে যাবে ট্রাম্পের !!

যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে কার্স্টজেন নিয়েলসেন বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন। এ ঘটনায় খুশি হওয়ার কিছু নেই। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে বহু পরিবারের সদস্যদের জোরপূর্বক আলাদা করার এবং ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্তু–জানোয়ারদের মতো তারের খাঁচায় আটকে রাখার মতো নিষ্ঠুর কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নিয়েলসেনের পদত্যাগে পরিস্থিতি বদলাবে, এমনটি আশা করার সুযোগ নেই। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর জায়গায় এমন একজনকে বসাতে চাইছেন, যিনি আরও অনেক বেশি নিষ্ঠুরভাবে অভিবাসনবিরোধী নীতি অনুসরণ করার পক্ষে।
ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি প্রায় সব দিক থেকেই আতঙ্কের উদ্রেক করে। এখনো হয়তো তাঁর প্রশাসনের কুটিলতম চেহারার সবটুকু অভিবাসীরা দেখতে পায়নি। অবশ্য ইতিমধ্যেই ট্রাম্প অভিবাসীদের ‘অপরাধী’, ‘ধর্ষক’ এবং ‘জানোয়ার’ বলেছেন।

তবে অনেকেই চিন্তা করছেন, ট্রাম্পের নারীবিদ্বেষ অথবা সীমাহীন অশ্লীলতা ও নিষ্ঠুরতার আরও কী বাকি আছে? শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রতি তাঁর নির্লজ্জ সমর্থন এখন কোন অবস্থায় আছে? প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কিংবা ইরান নিউক্লিয়ার চুক্তি থেকে সরে আসার পর এখন ট্রাম্প নতুন করে আবার কী অঘটন ঘটাতে যাচ্ছেন? তিনি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছেন, তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
মর্মান্তিক বিষয় হলো, এই অসুস্থ খেলার সমাপ্তি খুব শিগগির হবে না। ট্রাম্প নিজে একজন অস্থির মানসিকতার লোক। তিনি যে অস্থির ব্যবস্থা চালু করে যাচ্ছেন, তার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে তথা বিশ্ববাসীকে বহুদিন ধরে খেসারত দিয়ে যেতে হবে।
ট্রাম্প যেসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যাচ্ছেন, তার মধ্যে যেটি আমাকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করছে, সেটি হলো সামাজিক অস্থিরতা। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) অ্যাজেন্ডা আর যা–ই হোক এটি অন্তত আমেরিকাকে নৈতিক নেতৃত্ব ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এই স্লোগানের মধ্যে তিনি চরম স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার বীজ রুয়ে দিয়েছেন।

মূলত অর্থনীতিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা থেকেই ‘মাগা’ স্লোগানটি চালু করেছেন ট্রাম্প। কিন্তু সেই স্লোগান আমাদের এই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে: আজকে আমেরিকা যে সম্পদের বড়াই করে, সেই সম্পদের ভিত্তি কী?
১৭৭৬ সালে লেখা দ্য ওয়েলথ অব নেশনস বইয়ে অ্যাডাম স্মিথ এর উত্তর দিয়ে গেছেন। স্মিথ বলেছেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের জীবনমান স্থির হয়ে ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে তা সচল হয়। তখন মানুষের আয়–রোজগার বাড়তে থাকে। কিন্তু কেন? এটি সম্ভব হয়েছিল অভিবাসনের হাত ধরে। আদান–প্রদান বাড়ানোর মধ্য দিয়ে।

ইউরোপের সমাজসংস্কারের পেছনে একটি বিরাট আন্দোলন কাজ করেছিল। সেই সমাজ তখনকার রাষ্ট্র ব্যবস্থার সামনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল। যেমন: আমরা কী করে সত্যকে জানতে পারব? আমাদের চারপাশের বিশ্বকে জানার জন্য আমাদের কী করতে হবে? আমরা আমাদের সমাজকে কীভাবে সংগঠিত করতে পারি? এই সব প্রশ্নের জবাবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গোটা সমাজব্যবস্থাকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে নিয়ে গেছে।

সেই স্মিথের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত একটি জাতির সম্পদ ও অগ্রগতি মানুষের সৃজনশীলতা ও উৎপাদন সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। সমাজের সঙ্গে সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদান–প্রদান যত বাড়বে, তত বেশি মানুষের মধ্যে এই সৃজনশীলতা বাড়বে। একটি দেশের নাগরিকেরা অন্য দেশে অভিবাসন নিয়ে গেলে দুই দেশের মধ্যে এই আদান–প্রদানের পথ সুগম হয়। ট্রাম্প সেই পথ বন্ধ করে দিচ্ছেন। অভিবাসীদের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অরক্ষিত ভাবতে বাধ্য করছেন। এটি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকেই অরক্ষিত করে তুলছে।
যেসব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জোরে এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সারা বিশ্বের কাছে আদর্শ হয়ে টিকে আছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তিও তিনি ভেঙে দিতে শুরু করেছেন। আদালত, নজরদারি সংস্থা, প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যম—এগুলোর প্রতি মানুষের যে আস্থা ছিল, ট্রাম্প কৌশলে তাতে চিড় ধরিয়ে দিয়েছেন।

এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ মানুষের অগাধ আস্থা ছিল। কিন্তু গত তিন–চার বছরে ট্রাম্প প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সেসব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মনে হচ্ছে খুব পরিকল্পিতভাবে ট্রাম্প এসব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। এই ধারাবাহিকতা হঠাৎ থেমে যাবে, তা আশা করা যায় না। আগামী নির্বাচনে যদি ট্রাম্প নির্বাচিত হতে না–ও পারেন, তাহলেও তাঁর নেতিবাচক রাজনীতির রেশ থেকে যাবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ ই স্টিগলিৎজ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ

Leave a Reply