‘আমি না থাকায় সম্ভাবনা এক পার্সেন্টও কমেনি’

বাঁ হাতের অনামিকাটা একটা পাত দিয়ে সোজা করে ব্যান্ডেজ করে রাখা। বিপিএল ফাইনালে ব্যাটিংয়ের সময় সেটি ভেঙে যাওয়ায় ছিটকে পড়েছেন নিউজিল্যান্ড সফর থেকে। যে নিউজিল্যান্ড বলতে গেলে সব সময়ই তাঁর সেরাটা বের করে আনে। গতকাল সিরিজ শুরুর আগের বিকেলে বনানীতে নিজের বাসায় উৎপল শুভ্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাকিব আল হাসান দাবি করলেন, তিনি না থাকায় বাংলাদেশের সম্ভাবনাটা একটুও কমেনি।

উৎপল শুভ্র: হাতের আঙুল তো দেখি বড় যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়াল আপনার জন্য।
সাকিব: না, ঠিক আছে। এর আগে তো কখনো এ রকম আঙুল নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি।

শুভ্র: কী বলছেন? গত বছর এশিয়া কাপের সময়ই তো আপনার আঙুল নিয়ে সারা দেশে তোলপাড়…
সাকিব: দু-একবার হয়েছে। তবে সর্বশেষ কিছুদিন আগে তো আঙুল নিয়ে এ রকম দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। ভালোই ছিলাম, আঙুলগুলো সুন্দর লাগত। অন্যদের আঙুল দেখে বরং ভাবতাম যে আমার আঙুলগুলো কত সুন্দর! তবে গত কিছুদিনে বেশ কবার হলো। (বাঁকা হয়ে থাকা ডান হাতের অনামিকা দেখিয়ে) এটা হয়েছে বিপিএল সেমিফাইনালে। এই দেখেন, এই যে।

শুভ্র: এটাও ভেঙেছে নাকি?
সাকিব: ভাঙে নাই। তবে কিছু একটা হয়েছে। ব্যথা আছে। বাঁকা হয়ে গেছে, সোজা আঙুলটা এখন বাঁকা। কিছুদিন ধরে আঙুলের ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

শুভ্র: আগামীকাল (আজ) বাংলাদেশের ম্যাচ, আপনার এখন দলের সঙ্গে নেপিয়ারে থাকার কথা ছিল আর আপনি ভাঙা আঙুল নিয়ে ঢাকায় বসে আছেন। নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে।
সাকিব: আমি আসলে এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না।

শুভ্র: একটু মন খারাপও হয় না?
সাকিব: হ্যাঁ, খেলা যখন দেখি, তখন হয়। খেলতে পারলে ভালো হতো। তবে কিছু তো করার নাই…পরের দিন যাওয়ার কথা ছিল, আগের দিন ইনজুরিতে পড়ে গেলাম।

শুভ্র: কাল খেলা দেখবেন না?
সাকিব: পুরোটা তো দেখতে পারব না, ঘুম থেকে উঠে দেখব।

শুভ্র: কাল তো ম্যাচ সাতটায় শুরু…
সাকিব: এত তাড়াতাড়ি ওঠার সম্ভাবনা নাই। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাব। উঠে ১১টা-সাড়ে ১১টা থেকে দেখব। সেকেন্ড ইনিংস দেখব হয়তো।

শুভ্র: আচ্ছা, নিউজিল্যান্ড বলে কি একটু বেশি আফসোস হওয়ার কথা না? নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তো আপনার পারফরম্যান্স দুর্দান্ত, বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডে টেস্ট সিরিজে। ব্যাটিং গড় বোধ হয় ৭৩-এরও বেশি…
সাকিব: যেটা বললাম, খেলা দেখার সময় একটু খারাপ লাগবে। সেটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া আসলে তো কিছু করার নাই।

শুভ্র: নিউজিল্যান্ডে আপনার তিনটি সফর-২০০৭-০৮, ২০১০ ও ২০১৭। এর প্রথমটিতে তো আপনি একেবারে তরুণ। একটা টেস্টে বাদ পড়েছিলেন না? ওয়েলিংটনে শেষ টেস্টটায় মনে হয় খেলেননি…
সাকিব: না, ডানেডিনে প্রথম টেস্টে খেলিনি, ওয়েলিংটনে খেলেছি। ওইখানেই আসলে ক্যারিয়ারটা টিকে গিয়েছিল। মানে ওই টেস্ট খারাপ খেললেই আবার বাদ পড়তাম। প্রথম ইনিংসে ৫ করেছি, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪১ করায় বেঁচে গেছি।

শুভ্র: ২০১০ সালে পরের সফরে তো একটাই টেস্ট। হ্যামিল্টনে আপনার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৮৭…সবার আগে কী মনে পড়ে?
সাকিব: খুব বেশি কিছু মনে নাই। শুধু মনে আছে, পার্টনার ছিল রাজীব (শাহাদাত হোসেন)। রিয়াদ ভাইও সেঞ্চুরি করেছিলেন। এ ছাড়া আর খুব বেশি কিছু মনে নাই। প্রথম ইনিংসে যে আউটটা…ওটা (আউট) ছিল না, ওটা মনে আছে। ম্যাককালাম খেলা শেষে নিজেই বলেছে।

শুভ্র: সেবার ক্রাইস্টচার্চ ওয়ানডেতে আপনি ৪ উইকেট নিয়েছিলেন। সিরিজে ওই একটা ম্যাচেই একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব জেগেছিল। ওই যে ইমরুল যেটায় সেঞ্চুরি করলেন…
সাকিব: ওটা কি ক্রাইস্টচার্চে, না অকল্যান্ডে? অকল্যান্ড।

শুভ্র: ওটা ক্রাইস্টচার্চে।
সাকিব: অকল্যান্ড।

শুভ্র: আমি নিশ্চিত, ক্রাইস্টচার্চ-ল্যাঙ্কাস্টার পার্কের ড্রপ ইন উইকেটটা একটু শুকনো ছিল বলে আপনি ভালো টার্ন পেয়েছিলেন।
সাকিব: আমার এখনো মনে হচ্ছে অকল্যান্ডে। যেখানেই হোক, বোলিংটা ভালো করছিলাম, এটা মনে আছে। রস টেলর স্টাম্পড হয়েছিল, কে আরেকজন বোল্ড হয়েছিল।

শুভ্র: আর সর্বশেষ সফরে ওয়েলিংটনে ২১৭?
সাকিব: এটা তো মাত্র কিছুদিন আগের। মনে আছে মোটামুটি। এক দিনেই তো সব রান করলাম। ৫ রানে অপরাজিত ছিলাম আগের দিন, পরের দিন আউট হওয়ার পরও আরও ঘণ্টাখানেক বাকি ছিল ইনিংস।

শুভ্র: ওই ইনিংসের আগে-পরে কোনো স্পেশাল কিছু আছে?
সাকিব: ওই রকম কোনো স্পেশাল কিছু নাই। ‘লাইফ’ পেলাম তো শুরুতেই বোধ হয়, ৪ রান না ৫ রানে।

শুভ্র: সেটি ছিল টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর। এটার কোনো আলাদা অনুভূতি ছিল না? ড্রেসিংরুমে কিছু হয়নি, বা আলাদা কেউ কিছু বলেনি?
সাকিব: না, সবাই অবশ্যই অনেক খুশি হয়েছে। অনেক অ্যাপ্রিশিয়েটও করেছে। তবে আলাদা করে বলার মতো কিছু নাই।

শুভ্র: কিছুই না?
সাকিব: পরের দিন সূর্য উঠেছিল, উইকেটটা ভালো ছিল, বল ব্যাটে আসছিল। প্রথমে অনেকক্ষণ সারভাইভ করেছি, যখন ওরা টানা বাউন্সার দিয়ে যাচ্ছিল। এরপর টানা শট খেলেছি। যা খেলেছি, তাই লেগেছে ব্যাটে। কাভার ড্রাইভ বলেন, পুল বলেন আর স্কয়ার কাট বলেন, সবই খেলেছি, আর সব ব্যাটেও লেগেছে।

শুভ্র: এটা কি ওই সব দিনের একটা, যখন ব্যাটসম্যানের মনে হয় আজ যা করতে চাইব, তা-ই হবে?
সাকিব: বলতে পারেন ওরকম। তবে ওখানে শুরুতে অনেক কষ্টও করতে হয়েছে।

শুভ্র: টেস্টে আপনার সর্বোচ্চ ইনিংসের মতো সেরা বোলিংও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১০ সালে বাংলাওয়াশের ওই সিরিজেও বলতে গেলে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডকে। তা নিউজিল্যান্ড নিয়ে ভিন্ন কোনো অনুভূতি কি হয় না? ওদের তো আপনাকে ভয় পাওয়ার কথা…
সাকিব: না, আলাদা কিছু না। তবে ওদের সঙ্গে অনেকগুলো ম্যাচেই এমন হয়েছে। গত বছর কার্ডিফে যেমন (চ্যাম্পিয়নস ট্রফি)। ওদের সঙ্গে টেস্ট-ওয়ানডে দুটিতেই সেঞ্চুরি আছে। আলাদা করে নিজের কাছে কিছু কখনো মনে হয়নি। কিন্তু যেহেতু পরিসংখ্যান ঘাঁটলে এ রকম কিছু বের হয়, তখন স্পেশাল মনেই হয়।

শুভ্র: আপনি না থাকাতে এই সফরে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা কত পার্সেন্ট কমে গেছে?
সাকিব: আমার তো মনে হয় না, এক পার্সেন্টও কমেছে।

শুভ্র: কেন, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে আপনার অমন পারফরম্যান্স…
সাকিব: এটা হচ্ছে এমন একটা খেলা, যেখানে একজনকে দিয়ে হার-জিতের হিসাব করাটা খুবই ভুল। দল হিসেবে ভালো খেললে বরং জেতার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। দল হিসেবে ভালো খেলতে হবে, এক-দুজনের পারফরম্যান্সে জেতাটা কঠিন হবে। যদি না কেউ অবিশ্বাস্য কিছু, আউট অব দ্য বক্স করে ফেলে।

শুভ্র: নিউজিল্যান্ডে তো বাংলাদেশ এখনো কোনো ম্যাচ জেতেনি। আপনার কী মনে হয়, এবার বাংলাদেশ কেমন করবে?
সাকিব: চ্যালেঞ্জ হবে। তারপরও আমি মনে করি, ওয়ানডেতে সম্ভাবনা আছে। আর টেস্টে যদি আমরা কোনোভাবে একটা ম্যাচও ড্র করি, আমার কাছে সেটাই ভালো অর্জন। কারণ, আমাদের ওখানে সবকিছুতে জিরো।

শুভ্র: গত সফরে তো ওয়েলিংটনে ড্র হয়ে যাওয়া টেস্টও বাংলাদেশ হেরে এসেছে…
সাকিব: (হাসি) হ্যাঁ। যদি আমরা একটা টেস্ট ড্র করতে পারি…দুইটা টেস্ট ড্র করতে পারলে তো খুবই ভালো হবে। যেহেতু নিউজিল্যান্ডে উইকেট এখন ভালো, ব্যাটিংটা ভালো করতে পারলে সম্ভাবনা আছে। দুই ইনিংস মিলে যদি ৮০০-র ওপরে রান করে ফেলা যায়, তাহলে সম্ভব। সেটা ৫০০-৩০০-ও হতে পারে। প্রথম ইনিংসে ন্যূনতম ৪০০ করতে পারলে একটা ভালো সম্ভাবনা তৈরি হবে। ২০ উইকেট নেওয়াটা আমার কাছে মনে হয় কঠিন। কারণ, আমরা যদি ওরকম রান করতে পারি, ওদের আরও বেশি রান করার কথা। এটা হলো সম্ভাবনার কথা, আর আশাবাদের কথা বললে বলব, বাংলাদেশ জিতবে। ওয়ানডেতে একটা ম্যাচও জিততে পারলে ভালো, সিরিজ জিতে গেলে তো কথাই নেই। আর টেস্ট যদি একটা জিতে যায়…হতেই পারে, অসম্ভব কিছু না। তবে বাস্তবতার দিক থেকে ওটা বললাম, আর স্বপ্নের দিক থেকে এটা।

শুভ্র: নিউজিল্যান্ডে নিউজিল্যান্ড এত কঠিন কেন?
সাকিব: কন্ডিশনটা সবচেয়ে বড় কারণ। আর যদি প্ল্যানিংয়ের দিক থেকে চিন্তা করি, পৃথিবীতে যে কয়েকটা দল সবচেয়ে ভালো প্ল্যানিং করে, নিউজিল্যান্ড এর মধ্যে একটা। সবকিছু সিস্টেমেটিক, প্ল্যান অনুযায়ী করে। জার্মানির ফুটবলের মতো আরকি। মনে হবে যেন মেশিন। ওরা জানে যে কী কী করতে হবে। আর নিজেদের দেশে ওরা অনেক ভালো একটা দল। আর আমাদের সমস্যা হলো, আমরা তো প্রতিবছরে দেখা যাচ্ছে একবার বাইরে যাই। তারপরও এবার সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খেলোয়াড় যাচ্ছে, যারা এর আগেও নিউজিল্যান্ডে খেলেছে।

শুভ্র: এবার প্রস্তুতিটা একটু কম হয়ে গেল না?
সাকিব: একটু না, অনেক কমই বলব। আমার মনে হয়, যদি এখানে দুই সপ্তাহ বা ন্যূনতম দশ দিনের ক্যাম্প করে সাত-আট দিন হাতে সময় নিয়ে ওখানে যেতে পারতাম, তাহলে আমাদের জন্য একেবারে আদর্শ প্রস্তুতি হতো।

শুভ্র: বাংলাদেশের ট্রাম্প কার্ড কে হতে পারে এই সিরিজে, আর নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করেন কাকে?
সাকিব: ওপরের ব্যাটসম্যানদের ভালো করতে হবে। এটা একদম গৎবাঁধা কথার মতো মনে হলেও ওপরের দিকের ব্যাটসম্যানরা ভালো না করলে নিচের দিকের ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশকে জেতার মতো অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। শুরুটা ভালো হলে পরের দিকে ওই আত্মবিশ্বাসটা কাজ করে। যেহেতু মুশফিক ভাই খুব ভালো ব্যাটিং করছেন, রিয়াদ ভাই প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো করেছেন, সাব্বিররা আছে। সবাই ক্লিক করলে বড় একটা রান হবে। বোলিংয়েও শুরুটা গুরুত্বপূর্ণ। ওরা ব্যাটিংয়ের শুরুতে খুবই পজিটিভ খেলে, মানে দুই ওপেনারই খুব মারতে থাকে।

শুভ্র: বাংলাদেশের ওপরের দিকের ব্যাটসম্যান বলতে কি তামিম?
সাকিব: তামিম প্রতিদিন ভালো খেলবে, এমন কোনো গ্যারান্টি নাই। আর প্রতিদিন যদি আরেক পাশ থেকে শুরুতেই আউট হয়ে যায়, সেটাও ভালো হবে না। আমি চাই, যে দুজনই ওপেন করুন, দুজনই ভালো খেলুক। দুজন মিলে যদি ৫০-৬০-৭০ রানের জুটি দিতে পারে, তিন ম্যাচের দুটিতেও দিতে পারে, আমাদের জন্য খুব ভালো হবে। আর নতুন বলে বোলিংটাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বলে উইকেট নিতে না পারলে খেলাটা ছুটে যাবে।

শুভ্র: আর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি?
সাকিব: কেন উইলিয়ামসন সব সময় বড় হুমকি। আর বোলিংয়ে যদি পেসের কথা চিন্তা করি… জানি না, ফার্গুসন আছে কি না ওয়ানডেতে…

শুভ্র: আছে।
সাকিব: ও যদি খেলে, ও যেহেতু ১৪৫ প্লাসে বল করছে, স্বাভাবিকভাবেই এটি আমাদের জন্য বড় একটা হুমকি হবে। সাউদিরও অনেক স্কিল আছে। একটা বড় আফসোস, আমাদের কোনো রিস্ট স্পিনার নাই। ওদের আছে। আর রিস্ট স্পিনাররা আমাদের সব সময়ই একটু ঝামেলায় ফেলে।

আরও পড়ুন:
যে জীবন শিশিরের

Leave a Reply